হাইকু

হাইকু হচ্ছে এক ধরনের কবিতা। সাইজে ছোট। সাধারনত হাইকুতে দুইটা দৃশ্য থাকে এবং তাদের মিলাইয়া থাকে আরেক লাইন। তবে জাপানি হাইকু এক লাইনে হইত। এবং তার নিয়ম ছিল ৫-৭-৫ মোরাস মিলে ১৭ মোরাসের কবিতা। জাপানি ভাষায় তিন ধরনের অক্ষর বিদ্যমান (হিরাগানা, কাতাকানা ও কানজি); এবং তার প্রয়োগ হইত হাইকুতে। এছাড়া হাইকু আবৃত্তিরও নিয়ম কানুন ঠিক করেছিলেন কোন কোন হাইজিন। হাইজিন হইলেন হাইকুর কবি।

যেহেতু জাপানি ভাষা জানা নাই, তাই এতসব বিচার কইরা হাইকু পড়তে যাই নাই। এর সরলতা দেইখা পড়তে ও বুঝতে গেছি। ভালো লাগছে।

হাইকু উপভোগ করতে হয় এর টোনের সাথে নিজেরে মিলাইয়া। নিজেরে মানে নিজের অভিজ্ঞতারে। একেকজনের অভিজ্ঞতা যেহেতু আলাদা, যেহেতু অভিজ্ঞতা ভিন্নতা তৈয়ার করে মানুষে মানুষে তাই হাইকু একেকজন একেকভাবে উপভোগ করে থাকেন।

হাইকু বলতেই যেই জাপানিজ কবির নাম আসে তিনি মাতসুও বাশো (১৬৪৪-৯৪)। বাশো ছিলেন একজন সামুরাই। এইটা সম্মানজনক যোদ্ধা র‍্যাংক। কিন্তু কবি তা ত্যাগ করে কবিতা লেখা শুরু করেন। এবং দারুণ কবি খ্যাতি পান তিনি।

তিনি একাকীত্বে ভুগতেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াইতেন। অনেকসময় বন্ধুবান্ধব হইতেও দূরে গিয়া থাকতেন। তার কবিতায় দুই জেন শিক্ষা আছে বা তিনি রাখতে চাইতেন। ওয়াবি এবং সাবি। ওয়াবি বলতে একেবারে সহজ, সাধারন, কঠোর সংযমী জীবন যাপন। সাবি হচ্ছে অসম্পূর্নতারে সম্মান ও মর্যাদার সাথে গ্রহণ। এই দুই জিনিস জেন বুদ্ধিজমের গুরুত্বপূর্ন দুই ব্যাপার। জেন বুদ্ধিজমে অসম্পূর্নতারে মর্যাদা দেয়া বিষয়টারে এভাবে বুঝানো হয়, একটা পাত্র সাধারন। কিন্তু হাত থেকে পড়ে ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে গেল। তখন এই টুকরাগুলো জোড়া লাগালে পাত্রটি হবে অসাধারন। কারণ তার ভিতরে তখন অসম্পূর্নতা আসবে। জেন এই শিক্ষার মূলে আছে মানব জীবনের অসম্পূর্নতারে যাতে মানুষ গ্রহণ করতে পারে।

মানুষ সাধারণত এই ভ্রমে থাকে যে তার লাইফ একসময় পারফেক্ট হবে। বাচ্চা পোলা ভাবে সে বড় হবে, খ্যাতি পাবে, বিয়া করবে, তার বাচ্চা কাচ্চা হবে; এবং তার হবে একটা সুখী পারফেক্ট জীবন। কিন্তু তা হয় না। সব ধাপেই কিছু ইম্পারফেকশন বা অসম্পূর্নতা তার জীবনরে জড়াইয়া ধইরা রাখে। জেন শিক্ষা সাবি, এই অসম্পূর্নতার সৌন্দর্যরে দেখার শিক্ষা।

বাশো কবিতায় লাইটনেস তথা হালকাত্বের ধারনায় বিশ্বাস করতেন। তার মতে ভালো কবিতা হচ্ছে সেটা, যার লাইন এবং সংযুক্তকারী লাইন এতো হালকা হবে যেন একটা নদী আলতোভাবে বয়ে যাচ্ছে কোন বালুকাময় স্তরের উপর দিয়ে। সংযুক্তকারী লাইন বলতে তিনি হাইকুর শেষলাইন বুঝিয়েছেন।

বাশো’র দশটি হাইকু ইংরাজি থেকে বাংলায় ভাষান্তরঃ

এক-

কেহ নাহি যায়

এই পথে, আমি ছাড়া

এই শরতসন্ধ্যাকালে।

দুই-

ঝলকিত বিদ্যুৎ

কান্না সারসের

অন্ধকারকে বিদ্ধ করে ছুরিতে।

তিন-

সময়ে সময়ে আসে মেঘমালা

লোকেদের দেয় এক বিশ্রামের সুযোগ

চাঁদ দেখা হতে।

চার-

কেনো এতো অস্থিসার, হে বিড়াল?

পেট-মোটা মাছের জন্য

না ইঁদুরের?

নাকি পিছন-উঠানের ভালোবাসার?

পাঁচ-

শিশিরবিন্দু, আমারে ধুইতে দেও

তোমার অল্পকালস্থায়ী

মিষ্টি জলে

আমার জীবনের এই কালো দুই হাত।

ছয়-

তুষারোভিত সকাল

ওই কালো কাক

আমি ঘৃণা করি প্রচন্ড…

তবুও সুন্দর সে!

সাত-

মাছের দোকান

কী শীতল ঠোঁট

লবণাক্ত ব্রীমের।

আট

মশা মাছি উকুনেরা কামড়াইতেছে

জেগে থাকা সারারাত

একটি ঘোড়া মুতিতেছে কানের পাশে আমার।

নয়

ভায়োলেটস-

কী অমূল্য

একটি পাহাড়ের পথে।

দশ

হলুদ গোলাপ পাপড়ি

মেঘগর্জন-

একটি জলপ্রপাত।

———————————————–

বাশো’র হাইকু পড়ে আমারও হাইকু লেখতে ইচ্ছা হয়। এগুলি লেখা হইল।

মুরাদুল ইসলামের বারোটি হাইকু-

এক

ঘুমের মধ্যে রাইত
স্বপ্নে বাঘ
ভোর হইয়া আসে।

দুই

বুদ্ধিজীবি

পেয়ারা খান

কাঠবিড়ালী বিলুপ্তপ্রায়।

তিন

জলে চাঁদ দেখা যায়

নৌকা কাঁপে

লী পো চাঁদ ধরতে ধরতে নদীতে ডুবে যান।

চার

ভোরের পবিত্র আলো আর বাতাস

কুয়াসা, শিশির দূর্বাঘাসে

উঁচা উঁচা গুয়া গাছের উপরে আসমান।

পাঁচ

সন্ধ্যা হইয়া আসে

জানলায় বসে উইপোকা

দূরে দূরে গুয়া গাছ দেখা যায়।

ছয়

জানলার পাশে পাঁচিল

মোরগ দিনে কয়েকবার

আসে আর গলা ছেড়ে গায়।

সাত

ইনবক্সে মেসেজ জমে

বারুদে বারুদে শোভিত পকেট

হাতের আঙুল থেকে খসে সিগারেট।

আট

আয়নার সামনে

নিজেরে দেখতে দাঁড়াইয়া

কারে যেন দেখি!

নয়

ও কাঠবিড়ালী

তোমার চক্ষে চক্ষু রাখি

আমগাছে বইয়া থাকে ঝিঁঝিঁ।

দশ

ব্যাঙ ডাকে

বৃষ্টি আসবে নাকী!

শতবর্ষ পরে।

এগারো

আসমানে চাঁদ নাই

ঘরে অন্ধকার

খাটের তলায় বাচ্চাসহ বিড়ালের অস্থায়ী সংসার।

বারো

কিতার শব্দ করে?

পায়ে পায়ে বিলাই

রাক্ষসের হাসি শুনে হরিলাল।

শেয়ার